পুষ্টিপাড়ায় ভিটামিন সি , এ , বি , ডি এবং ই এর মাঝে ভিটামিন-কে যেন এক আগন্তুক । এতো এতো ভিটামিনের মাঝে ভিটামিন কে এর নাম খুব একটা শোনা যায় না । কিন্তু এটি দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ভিটামিন ।
“ভিটামিন কে” চর্বিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন। এই ভিটামিন রক্ত জমাট বাঁধা এবং হাড়ের স্বাস্থের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ভিটামিন কে-এর অভাবজনিত রোগও হতে পারে ভয়ানক। তাই আজকে আমরা ভিটামিন কে এবং কিভাবে ভিটামিন কে-এর ঘাটতি জনিত সমস্যার সাথে মোকাবেলা করা তা সর্ম্পকে বিস্তারিত জানবো।
ভিটামিন-কেঃ
ভিটামিন কে আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯২৯ সালে রক্ত তঞ্চনের জন্য এসেন্সিয়াল নিউট্রিয়েন্ট হিসেবে । আর “ভিটামিন কে” নামটি এসেছে জার্মান শব্দ Koagulationsvitamin থেকে।
এটি রক্ত তঞ্চনে , হাড়ের বিপাকে এবং রক্তের ক্যালসিয়াম লেভেল নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও প্রোথ্রোম্বিন উৎপন্ন করে , যেটি একটি প্রোটিন এবং ক্লটিং ফ্যাক্টর যা রক্ত তঞ্চনে এবং হাড়ের বিপাকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
যদি আপনার দেহে ভিটামিন কে-এর ঘাটতি থাকে ,তাহলে দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে এই প্রোটিন উৎপন্ন হবে না ।
মূলত দুই প্রকারের ভিটামিন কে রয়েছে । যেমন,
১) ভিটামিন কে১ঃ
ভিটামিন কে১ বা Phylloquinone মূলত আসে উদ্ভিদ উৎস থেকে,বিশেষত সবুজ শাকসবজিতে যেমন, পালংশাক এবং Kale।
মানুষ যখন কে১ গ্রহণ করে,তখন বৃহদান্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়া এর সংরক্ষণ র্ফম ভিটামিন কে২ তে পরিনত করে।
এটি শোষিত হয় ক্ষুদ্রান্তে এবং ফ্যাটি টিস্যু এবং যকৃতে সঞ্চিত হয়।
২) ভিটামিন কে২ঃ
ভিটামিন কে২ বা Menaquinone প্রাকৃতিকভাবে অন্ত্রের নালীতে তৈরি হয় ( সাধারণ গাট ফ্লোরা তৈরি করে ) এবং কে১ এর মতো একইভাবে কাজ করে।
ভিটামিন কে২ এর উৎস অনেক কম,এটি বৃহত্তরভাবে প্রাণীজ উৎস ( মাংস , ডিম ) এবং ফারমেন্টেড ফুডে পাওয়া যায়।
ভিটামিন-কে এর উৎস সমূহঃ
ভিটামিন কে উচ্চ পরিমাণে চোখে পড়ে সবুজ শাকসবজি যথাঃKale এবং swiss chard এ। অন্যান্য উৎসের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ভোজ্য তেল এবং কিছু ফল।
শাকসবজি ভিটামন কে১ এর ভালো উৎস। অন্যদিকে Menaquinone বা কে২ পাওয়া যায় মাংস , দুগ্ধজাত পণ্য , ডিম এবং জাপানিজ খাবার Natto (ফারমেন্টেড সয়াবিন থেকে তৈরি)।
নিম্নে উচ্চ ভিটামিন কে যুক্ত খাবারের তালিকা দেওয়া হলঃ
১। সবুজ শাকসবজিঃ পালংশাক,লেটুস,ব্রোকলি, সুইস চার্ড,কলার্ড গ্রিনস,ব্রাসেল স্প্রাউট ইত্যাদি।
২। ভোজ্য তেল
৩। ফলমূলঃ ব্লুবেরি,ডুমুর, কিউই এবং আলুবোখারা ।
৪। মাংসঃ এখানে যকৃত অন্তর্ভূক্ত থাকবে।
৫। চিজ
৬। ডিম
৭। ছোলা
৮। সয়াবিন
৯। গ্রিন টি
১০। Natto
দৈনিক “ভিটামিন-কে” গ্রহন এর পরিমাণঃ
অধিকাংশ ব্যক্তি তাদের ডায়েট থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন কে পেয়ে থাকে। তাই বয়স এবং লিঙ্গের উপর নির্ভর করে পর্যাপ্ত ভিটামিন কে সুপারিশ করা হয়।
নারীদের ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সি বা এর বেশি হলে পুরো দিনে ৯০ মাইক্রোগ্রাম এবং পুরুষদের দিনে ১২০ মাইক্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে । ভিটামিন কে মাইক্রোগ্রামে মাপা হয় ।
ভিটামিন কে গ্রহন এর প্রয়োজনীয়তাঃ
১) রক্ত তঞ্চনে সাহায্য করে ভিটামিন-কেঃ
ভিটামিন কে ছাড়া দেহ প্রোথ্রোম্বিন প্রোটিন তৈরি করতে পারে না। এটি একটি ক্লটিং ফ্যাক্টর যা রক্ত তঞ্চনে সাহায্য করে এবং হাড়ের বিপাকের জন্যও প্রয়োজনীয়।
ভিটামিন কে অতিরিক্ত রক্তপাতও রোধ করে ।
২) ভিটামিন-কে হাড়কে শক্ত ও মজবুত করেঃ
কম ভিটামিন কে-এর গ্রহণ এবং অস্টিওপরোসিসের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে। আর কতিপয় গবেষণায় পাওয়া গেছে, এটি হাড় শক্ত-মজবুত রাখতে সহায়ত করে।
সেইসাথে হাড়ের ঘনত্বের উন্নতিসাধন এবং হাড় ভেঙ্গে যাওয়া ঝুঁকি কমায়। যদিও এই বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন ।
৩) ভিটামিন-কে স্মৃতিকে ভালো রাখেঃ
রক্তে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন কে বয়স্কদের আকস্মিক স্মৃতি উন্নতির সাথে সংযুক্ত রয়েছে বলে জানা যায় এক গবেষণায়।
৪) স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে ভিটামিন-কেঃ
মিনারাইলেজেশন প্রতিরোধের মাধ্যমে রক্তচাপ কমাতে এবং হার্টকে অবাধে পুরো দেহে রক্ত পাম্প করতে সাহায্য করে।
এছাড়া পর্যাপ্ত ভিটামিন কে স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে ।
৫) Vitamin K Dependent Clotting Factors Deficiency:
Vitamin K Dependent Clotting Factors Deficiency বা VKCFD নামক বিরল বংশগত ব্লিডিং ডিজঅর্ডার এর ফলে রক্তপাত প্রতিরোধ করতে ভিটামিন কে মৌখিকভাবে অথবা ইনজেকশন সুপারিশ করা হয় ।
৬) নবজাতকের দেহে নিম্ন মাত্রায় ভিটামিন কে-এর কারনে যে রক্তপাতের সমস্যা হয় তা প্রতিরোধে মৌখিকভাবে বা পেশীতে শট (vitamin-k) দেওয়া হয়।
৭) অন্যান্য ভিটামিনের সাথে দল বেধে কাজ করে ভিটামিন-কে।
“ভিটামিন কে” ঘাটতির কারনসমূহঃ
যদিও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভিটামিন-কে ঘাটতির ঘটনা অনেক বিরল।
তবে কিছু কিছু ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভিটামিন কে ঘাটতির অত্যাধিক ঝুঁকি রয়েছেঃ
১। কুমারিন অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট গ্রহণ করেন এমন ব্যক্তি যেমনঃ Warfrain, যেটা রক্ত তরলীকরণ করে।
কুমারিন রক্ত তঞ্চনে যে প্রোটিন জড়িত তার উৎপাদনে হস্তক্ষেপ করে।
২। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ ভিটামিন কে-এর উৎপাদন এবং শোষণে হস্তক্ষেপ করে ।
৩। যে খাবার খাচ্ছেন তাতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন কে না থাকে ।
৪। দেহ সর্ম্পূণভাবে ফ্যাট শোষণ করতে না পারলে তখন একে ফ্যাট ম্যালঅ্যাবজরশন বলে।
যাদের এই সমস্যা আছে তাদের মাঝে ভিটামিন কে-এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে ।
সেইসব ব্যাক্তিদের এই সমস্যা হবে যারাঃ
-Celiac disease আক্রান্ত
-Cystic fibrosis আক্রান্ত
-অন্ত্রে অথবা পিত্তথলীতে কোন ব্যাধি আছে
-অন্ত্রের কোন অংশ অপসারিত করা হলে
৫। প্রচন্ডভাবে অ্যালকোহল পান করেন এমন ব্যক্তি।
৬। অপুষ্টির শিকার ব্যক্তি ।
৭। নবজাতকরা বিভিন্ন কারণে ভিটামিন কে ঘাটতির অত্যাধিক ঝুঁকিতে রয়েছেঃ
-মায়ের বুকের দুধে ভিটামিন কে খুব কম পরিমাণে রয়েছে ।
- মায়ের প্লাসেন্টা থেকে তার বাচ্চার দেহে ভিটামিন কে ঠিকভাবে হস্তান্তর হয় না ।
-নবজাতক যকৃত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারে না । - নবজাতক জীবনের প্রথম কয়েকদিন নিজে নিজেই ভিটামিন কে২ তৈরি করতে পারে না ।
আরও পড়ুন – স্পিরুলিনা – পুষ্টির গ্রীন ডায়মন্ড
“ভিটামিন কে” ঘাটতির লক্ষণ সমূহঃ
ভিটামিন কে ঘাটতির মূল লক্ষণ হল অতিরিক্ত রক্তপাত । তবে এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে রক্তপাত কাঁটা বা আঘাত প্রাপ্ত স্থান ছাড়াও দেহের যেকোন স্থানে হতে পারে । নিম্নে লক্ষণ সমূহ দেওয়া হলঃ
১। সহজেই আঘাত পাওয়া।
২। ক্ষত , বিদ্ধ হওয়া স্থান এবং ইনজেকশন অথবা অস্ত্রোপাচারের স্থান হতে অত্যধিক রক্তপাত হওয়া।
৩। নবজাতকের নাড়ি যেখান থেকে অপসারিত করা হয়েছে সেই স্থান হতে রক্তপাত হওয়া ।
৪। ত্বক , নাক , Gastrointestinal tract অথবা অন্যস্থাবে হতে রক্তপাত হওয়া ।
৫। নখের নিচে ক্ষুদ্রকারে রক্তজমাট বাঁধা ।
৬। যদি শিশুর সুন্নৎ করা হয় সেক্ষেত্রে শিশ্ন থেকে রক্তপাত হতে পারে ।
৭। মস্তিষ্কে হঠাৎ রক্তপাত যা অত্যন্ত ভয়ানক এবং প্রাণঘাতী ।
৮। ঘন কালো আলকাতরার মতো মল এবং মল বা মূত্রের সাথে রক্ত দেখা দেওয়া ।
৯। বর্ধিত প্রোথ্রোম্বিন টাইম ।
দেহে ভিটামিন কে এর ঘাটতি হলে কিভাবে নির্ণয় করা হয় ?
প্রথমত , আপনার ডাক্তার আপনার মেডিকেল হিস্ট্রি দেখবে এটা বোঝার জন্য যে আপনার ভিটামিন কে-এর অভাবের ঝুঁকি রয়েছে কিনা।
সাধারণত ঝুঁকিতে রয়েছে যারাঃ
- অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট নেন
- অ্যান্টিবায়োটিক নেন
- চর্বি শোষণে সমস্যা বেশি
সম্ভবত আপনার চিকিৎসক কোয়াগুলেন্ট টেস্ট সম্পন্ন করবেন যা ‘প্রোথ্রোম্বিন টাইম’ নামে পরিচিত। এটা করা হয় ভিটামিন কে -এর অভাবেই এই লক্ষণগুলো হচ্ছে কিনা নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য ।
তারা অল্প রক্তের নমুনা নিয়ে সেখানে রাসায়নিক যোগ করার পর লক্ষ্য করেন রক্ত তঞ্চনে কত সময় নেয় । রক্ত সাধারণত জমাট বাঁধতে ১১ থেকে ১৩.৫ সেকেন্ড সময় নেয়। যদি এর চেয়ে বেশি সময় নেয় তবে ভিটামিন কে ঘাটতির নির্দেশক হতে পারে । তাই এই পরীক্ষার আগে ভিটামিন কে যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।
International Normalized Ratio পরিমাপের মাধ্যমে , ল্যাব এই ফলাফল ভিন্ন উপায়ে দেখতে পারে। আইএনআর এমন স্কেল্ভিত্তিক যা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পরীক্ষাগারে ফলাফলের সাথে তুলনা করে।
একটি সাধারণত আইএনআর প্রায় ০.৯ থেকে ১.১ হয় । কেউ ব্লাড থিনার গ্রহণ করলে তার প্রায় ২ থেকে ৩.৫ হতে পারে । আপনার চিকিৎসক সংখ্যাটি খুব বেশি কিনা তা দেখার জন্য সন্ধান করবেন।
0 comments:
Post a Comment