হাইপারটেনশান কি?
হাইপারটেনশান (অধিক রক্তচাপ) হলো একরকমের দুরারোগ্য শারীরিক অসুস্থতা। এইক্ষেত্রে শিরা-ধমনীতে ক্রমাগত রক্তচাপ বেড়ে যায়। এই কারণে অসুস্থতা ও মৃত্যু বাড়ে।
অধিক রক্তচাপ সেইঅর্থে কোন রকমের লক্ষণ প্রকাশ না করেও অনেক বছর থাকতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত অধিক রক্তচাপ থেকে পর্যায়ক্রমে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি ফেলিওরের মতন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুতর সমস্যা বাড়ে।
দুটো সংখ্যায় রক্তচাপের মাত্রা লেখা হয় এবং এটা পারদের মিলিমিটার (এম এম এইচ জি) হিসেবে দেওয়া হয়।
ওপরের সংখ্যা বা সিস্টোলিক প্রেসার ভেন্ট্রিকুলার কন্ট্র্যাকশানের (হৃদস্পন্দনের সময়ে) কারণে রক্ত বের হবার ফলে হয়।
নিচের সংখ্যা বা ডায়াস্টোলিক প্রেসার হলো, ভেন্ট্রিকুলার কন্ট্র্যাকশানের সময়ে হওয়া আর্টারির চাপ।
রক্তচাপের রকমফেরঃ (ন্যাশনাল কমিটি অন প্রিভেনশান, ডিটেকশান, ইভালুয়েশান ও ট্রিটমেন্ট অফ হাই ব্লাড প্রেসারের ষষ্ঠ ও সপ্তম রিপোর্ট অনুসারে)
অপটিমাল- সিস্টোলিক প্রেসার ১২০-১২৯ এম এম এইচ জি/ডায়াস্টলিক প্রেসার ৮০ এম এম এইচ জি থেকে কম
স্বাভাবিক- সিস্টোলিক প্রেসার ১২০-১২৯ এম এম এইচ জি/ডায়াস্টলিক প্রেসার ৮০-৮৪ এম এম এইচ জি
বর্ডারলাইন- সিস্টোলিক প্রেসার ১৩০-১৩৯ এম এম এইচ জি/ডায়াস্টলিক প্রেসার ৮৫-৮৯ এম এম এইচ জি
হাইপারটেনশান- সিস্টোলিক প্রেসার ১৪০ এম এম এইচ জি বা বেশী/ডায়াস্টলিক প্রেসার ৯০ এম এম এইচ জি থেকে বেশী
স্টেজ১- সিস্টোলিক প্রেসার ১৪০-১৫৯ এম এম এইচ জি/ডায়াস্টলিক প্রেসার ৯০-৯৯ এম এম এইচ জি
স্টেজ২- সিস্টোলিক প্রেসার ১৬০-১৭৯ এম এম এইচ জি/ডায়াস্টলিক প্রেসার ১০০-১০৯ এম এম এইচ জি
স্টেজ৩- সিস্টোলিক প্রেসার ১৮০ এম এম এইচ জি বা বেশী/ডায়াস্টলিক প্রেসার ১১০ এম এম এইচ জি থেকে বেশী
হাইপারটেনশানের লক্ষণ ও উপসর্গ কি?
সাধারণত, হাইপারটেনশান হলো নীরবে বিশেষকরে বয়স বাড়ার সাথে বাড়ে। হাইপারটেনশানে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষ রক্তচাপ বিপদজনক মাত্রাতে পৌঁছে গেলেও কোন বিপদসঙ্কেত পান না।
গুরুতর হাইপারটেনশানে আক্রান্ত কিছু মানুষের নাক দিয়ে রক্তপাত, মাথাব্যথা, নিঃশ্বাসের দুর্বলতা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, বুকে যন্ত্রণা, দৃষ্টি বদলে যাওয়া, মাথাঘোরা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
কি কারণে হাইপারটেনশান হয়?
সাধারণত হাইপারটেনশানওকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ঃ
১. প্রাইমারি বা এসেনসিয়াল হাইপারটেনশান হলো সবথেকে প্রচলিত ধরণ এবং এটা বয়সের সাথে ধিরে ধিরে বোঝার মতন কোন কারণ ছাড়া বাড়ে।
২. সেকেন্ডারি হাইপারটেনশান অনেক সময়ে কোন অন্তর্নিহিত কারণ বা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের ব্যবহারের জন্য হয়। এটা আচমকা হতে পারে এবং প্রাইমারি হাইপারটেনশানের তুলনায় বেশী গুরুতর। বিভিন্ন পরিস্থিতি, বিষয় ও ওষুধের থেকে এটা হতে পারেঃ
- কিডনির সমস্যা
- নির্দিষ্ট এন্ডোক্রাইন টিউমার
- থাইরয়েডের সমস্যা
- অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপ্নিয়া
- কনজেনিটাল ব্লাড ভেসেলের সমস্যা
- ডিকনজেসেন্টস, জন্ম নিয়ন্ত্রক ওষুধ, দোকান থেকে কেনা ব্যথার ওষুধ ও প্রেসক্রিপশানের নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ
- কোকেন ও অ্যাম্ফিটামাইন্সের মতন বেআইনি ড্রাগস
- মদ্যপানে আসক্তি
হাইপারটেনশানের ঝুঁকি কি?
হাইপারটেনশানে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় যা তা হলোঃ
ঝুঁকির যেসব কারণ বদলানো যায় নাঃ বয়স, জাতি, রোগের পারিবারিক ইতিহাস
বদলানো সম্ভব এমন ঝুঁকির কারণঃ স্বাভাবিকের থেকে বেশী ওজন বা মেদবহুলতা, শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকা, ক্রমাগত চাপ-ধকল, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং অত্যাধিক পরিমান মদ ও তামাক।
নির্দিষ্ট আনুসাঙ্গিক বিষয়ঃ ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের অধিক মাত্রা, কিডনির রোগ এবং স্লিপ অ্যাপ্নিয়া। গর্ভাবস্থার কারনেও এটা হতে পারে।
হাইপারটেনশানের জটিলতা কি?
অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশান থেকে যে সব গুরুতর জটিলতা দেখা দেয় তা হলোঃ
হৃৎপিণ্ডের গুরুতর ক্ষতি- অত্যাধিক চাপ-ধকল কিন্তু শিরা-ধমনীকে শক্ত করে দেয় এবং হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয়। রক্ত চলাচল কমে যাবার কারণে অ্যাঞ্জিনা (বুকে ব্যথা), হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেলিওর হতে পারে।
স্ট্রোক- হাইপারটেনশান মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী শিরা-ধমনী আটকে দেওয়ার কারণে স্ট্রোক হতে পারে।
কিডনি ফেলিওর- হাইপারটেনশান, কিডনির রক্তবাহী নালিকে দুর্বল ও সঙ্কুচিত করতে পারে বলে সেটা থেকে কিডনির ক্ষতি ও ফেলিওর হয়।
অন্ধত্ব- হাইপারটেনশান আমাদের চোখের রক্তবাহী নালির ক্ষতি করার ফলে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
এইসব ছাড়া, হাইপারটেনশান থেকে অন্যান্য জটিলতা হতে পারেঃ
- অ্যানিউরিজম
- মেটাবোলিক সিনড্রোম
- কগনিটিভ ইমিপেয়ারমেন্ট
কিভাবে হাইপারটেনশান ডায়াগনোসিস করবেন?
সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশানের ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এইজন্য হেলথ কেয়ারের থেকে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করানোই রোগ নির্ণয়ের একমাত্র উপায়। সাধারণত ব্লাড প্রেসার কাফের (স্পিগমোম্যানোমিটার) দ্বারা রক্তচাপ মাপা হয়।
রক্তচাপ যদি বেড়ে যায়, তাহলে ডাক্তার কয়েকদিন বা সপ্তাহ আরও বেশী করে মাপতে বলতে পারেন। বাড়িতে ব্যবহারের জন্য, রক্তচাপ মাপার ডিজিটাল যন্ত্র কার্যকারী এবং এটা প্রেসক্রিপশান ছাড়াও কেনা যায়।
হাইপারটেনশানের সমস্যা থেকে গেলে, ডাক্তার নিম্নলিখিত ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সুপারিশ করে হাইপারটেনসিভ জটিলতা বুঝতে ও অন্তর্নিহিত ঝুঁকির কারণ দূর করতেও পারে।
- রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা
- অ্যাম্বুলেটরি টেস্ট
- ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম
- ইকোকার্ডিওগ্রাম ইত্যাদি
কিভাবে হাইপারটেনশানের চিকিৎসা হয়?
হাইপারটেনশানের চিকিৎসায় সবার আগে হৃৎপিণ্ড সংক্রান্ত জীবনযাত্রার স্বাস্থ্যকর বদল আনা দরকার। এই প্রক্রিয়া রক্তচাপের সমস্যা কমাতে কিংবা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ডাক্তার ওষুধ সুপারিশ করতে পারে।
ওষুধের ধরণ কিন্তু নানান কারণের ওপর নির্ভর করে, যেমনঃ
- রক্তচাপের পরিমাপ
- সার্বিক স্বাস্থ্য
- হাইপারটেনশানের ধরণ এবং
- কি কারণ চিহ্নিত হয়েছে
হাইপারটেনশানের চিকিৎসাতে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে আছে, ডিউরেটিক্স, অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভারটিং এনজাইম (এ সি ই), ইনহিবিটার, অ্যাঞ্জিওটেনশান II রিসেপ্টার ব্লকার (এ আর বি), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, আলফা ব্লকার, বিটা ব্লকার। অ্যাল্ডোস্টেরোন, রেনিন ইনহিবিটার, ভ্যাসোডায়ালেটার, সেন্ট্রাল অ্যাক্টিং এজেন্ট ইত্যাদি।
হাইপারটেনশান যদি অন্যান্য মেডিকাল কারণ বা ওষুধের (সেকেন্ডারি হাইপারটেনশান) কারণে হয়, সমস্যার নিরাময় অথবা ওষুধ বন্ধ করলে সেটা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
হাইপারটেনশান কিভাবে প্রতিরোধ করা হয়?
জীবনযাত্রা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর বদল এই হাইপারটেনশান কমাতে কিংবা প্রতিরোধ করতে পারবে। হাইপারটেনশানে প্রতিরোধ হৃদরোগ ও স্ট্রোকের মতন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি কমায়।
জীবনযাত্রা সংক্রান্ত বদল যা হাইপারটেনশান প্রতিরোধ ও কমাতে সাহায্য করে:
- খাবারে নুনের পরিমাণ কমান
- ফল ও সবজি সহ স্বাস্থ্যকর খাবার খান
- খাবার থেকে ট্রান্স ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট কমান/বাদ দিন
- শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন কিংবা নিয়মিত শরীরচর্চা করুন
- সঠিক ওজন বজায় রাখুন
- ধূমপান ত্যাগ করুন
- পরিমিত মদ্যপান করুন
- মানসিক চাপ সামলান এবং কমান
- শারীরিক অন্যান্য সমস্যা সামলান
- নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করুন
0 comments:
Post a Comment