Monday, October 10, 2022

মন ও মনের অসুখ


মন কি?
আমাদের সত্তার সঙ্গে মন এমন নিবিড়ভাবে মিশে আছে যে মন নিয়ে সাধারণতঃ চিন্তা ভাবনা করি না আমরা বা করার অবকাশও পাইনা। যদি করতাম তাহলে হয়তো কয়েকজন মনের অসুখে অসুখী মানুষের সান্নিধ্যে আসতাম আমরা। এবং নিজের মনের পরীক্ষানিরীক্ষা করতাম। 

মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ ও আলোচনা করে আমরা মনের সংজ্ঞা খুঁজি। দার্শনিক এবং ধর্মজিজ্ঞাসুরা যে মনের কথা বলেন তা ‘আত্মা’, যা দেহের অঙ্গীভূত হলেও দেহাতীত। মনোবিজ্ঞানী এবং স্নায়ু বিজ্ঞানীরা মনকে মস্তিস্কের অঙ্গীভূত মানুষের সত্তা এবং ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রক বলে মনে করেন।
মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি, বিবেচনা, স্মৃতি, আবেগ, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মস্তিস্কের অন্তর্নিহিত লক্ষ লক্ষ স্নায়ুকোষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। স্নায়ুকোষ গুলির ফাঁকে ফাঁকে থাকে ডোপেমিন (Dopamino) এবং অন্যান্য অ্যামিনো অ্যাসিড। অন্যান্য এইসব অ্যামিনো অ্যাসিড হলো সেরোটনিন (Serotonin), অ্যাড্রেনেলিন (Adrenalin) ও নর-অ্যাড্রেনেলিন (Nor-Adranalin)। এইসব রাসায়নিক পদার্থ স্নায়ুকোষগুলিকে যুক্ত করে পরিবাহকের (Neuro Transmitter) কাজ করে। এবং এই হরমোন গুলিই মনের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মস্তিস্ক মানুষের শুধু মন নয়। দেহের ক্রিয়াকলাপকেও নিয়ন্ত্রিত করে। জ্বরের তাপজনিত তড়কা,   উচ্চচাপের ফলে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ এবং মানসিক আঘাত জনিত মাত্রাধিক স্নায়বিক উত্তেজনা মস্তিস্কের ক্ষতি বা বিকার ঘটায়। ফলে কেউ কেউ বাকশক্তি হারায় অথবা অসংবদ্ধ প্রলাপ বকে। কেউ কেউ নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলে। মস্তিস্ক দেহের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যৌথভাবে দেহকে সজীব রাখে। কাজেই জীবিত মানুষ মাত্রেই মস্তিস্ক সজীব। মন যতই নির্জীব বা নিস্প্রভ হোক না কেন, আমরণ চলে মস্তিস্কের ক্রিয়াকলাপ।
মস্তিস্কে মনের সুখ ও অসুখের অভিব্যাক্তি
সুখী ও স্বাভাবিক যাদের মন তাদের মস্তিস্কের অন্তর্নিহিত ডোপেমিন এবং তাদের সঙ্গে সহ অবস্থিত সেরোটনিন (Serotonin), অ্যাড্রেনেলিন (Adrenalin) ও নর-অ্যাড্রেনেলিন (Nor-Adranalin) এর মধ্যে পরিমাণগত ভারসাম্য থাকে। এই ভারসাম্যের স্বরূপ (অর্থাৎ কোনটা কি পরিমাণে থাকে) তা অবশ্য জানা যায়নি। মনের চাপ (Mental Stress) সৃষ্টি করে এই ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে, অ্যাড্রেনেলিন (Adrenalin) ও নর-অ্যাড্রেনেলিনের (Nor-Adranalin) পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। অ্যাড্রেনেলিন (Adrenalin) এবং নর-অ্যাড্রেনেলিন (Nor-Adranalin) পরিমাণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে মস্তিস্ক হাইপার অ্যাড্রেনার্জিক (Hyper- Adrenergic) অবস্থায় উপনীত হয়। ফলে মানসিক অস্থিরতা এবং নৈরাশ্যবোধ বাড়তে থাকে এবং তা হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।
মনের নানা রকম অসুখ
মনের অসুখের চিকিৎসা যেসব চিকিৎসকরা করেন, তাঁরা মস্তিস্কের বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিডের বিন্যাস ও ভারসাম্য নিয়ে মাথা খুব বেশী একটা ঘামান না। তাঁরা অসুখের লক্ষণ দেখে রোগীর চিকিৎসা এবং ব্যাবস্থাপত্র করেন। 
কোন কোন লক্ষণ দেখে চেনা যায় মনের অসুখ!
১) অসংবদ্ধ চিন্তা
২) মানসিক বিষণ্ণতা
৩) দুশ্চিন্তাজাত স্নায়বিক উত্তেজনা
৪) নিজের বুদ্ধি এবং বিবেচনার উপর আস্থার অভাব
৫) নিজেকে মস্তিস্ক শূন্য বলে মনে করা
৬) হিংস্রতা
৭) অলীক কল্পনা প্রবণতার অনুভূতি
৮) বিভীষিকা দেখা
৯) হীনম্মন্যতায় ভোগা
১০) অকারন উদ্বেগ, সন্দেহ, আতঙ্কিত হয়ে পড়া
১১) স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, কিছুই মনে রাখতে না পারা
১২) আত্মহত্যার প্রবণতা
১৩) মনোবিকার
১৪) উন্মত্ততা
এছাড়া আরও বেশ কিছু লক্ষণ দেখে মনের অসুখগুলিকে শনাক্ত করেছেন মনোবিদরা। সেই লক্ষণ গুলি হল -
১) ম্যানিক ডিপ্রেশান (বিষণ্ণতা)
২) অ্যাংজাইটি নিউরোসিস বা দুশ্চিন্তা থেকে সৃষ্ট স্নায়বিক উত্তেজনা
৩) সাইজোফ্রেনিয়া বা চিত্তভ্রংশী অসুস্থতা
৪) অ্যালঝাইমার ডিজিজ (স্মৃতিশক্তি বিলুপ্তি)
৫) মাদকাসক্তিজনিত মনের অসুখ প্রভৃতি।
মানব সমাজে সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত মনের অসুখে ভোগা মানুষজন। ভারতে মনের অসুখ নিয়ে চর্চা খুব বেশীদিনের নয়। যদিও সম্প্রতি এই নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। নিত্য নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি মানুষের মনের অসুখকে নিরাময়ে ব্যাবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একজন মনের অসুখে ভোগা রোগী তিনি নিজেই জানেননা হয়তো কি কারনে বা কি অবস্থায় তিনি অবসাদের শিকার হয়ে পড়েছেন বা গভীর কোনো মনের অসুখে ভুগছেন বা কেন ভুগছেন। নিজেকে রোগী ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় শেষ হয়ে যায়। তাই শেষপর্যন্ত মনোবিদের কাছে যখন গিয়ে পৌঁছুলেন তখন হয়তো অনেক দেরী হয়ে গেলো। তাই  চিকিৎসকেরও শেষপর্যন্ত আর কিছুই করার থাকেনা। তাছাড়া ভারতের মতো দেশে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। তাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামীণ মানুষ, ওঝা বা গুনিন বা মোল্লাদের করুণা প্রার্থী হন। এবং তাক-তুকের মধ্যে দিয়েই এই মনের অসুখ ভালো হয়ে যাবে বলে মনে করেন। এই অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত না হতে পারলে সুস্থ এবং স্বাভাবিক সমাজ গঠন কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই উপরিউক্ত সমস্যা গুলি দেখলেই মনোবিদের সাহায্য নেয়া উচিৎ একদম দেরী না করেই। তাহলেই হয়তো সম্ভব এই মনের রোগ থেকে মুক্তি।

0 comments:

Post a Comment