ওরাল বা মুখের ক্যান্সার
মুখের যেকোন জায়গায় ক্যান্সারাস টিস্যুর বৃদ্ধি হওয়াকে ওরাল ক্যান্সার বলে এবং এটা মাউথ ক্যান্সার নামেও পরিচিত। ওরাল ক্যান্সার সাধারণত ঠোঁটের আস্তরণ এবং মুখের ভেতরে্র স্কোয়ামাস কোষে হয়। এটা স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা নামেও পরিচিত। ঠোঁট, গলা, গাল, মুখের ভেতরের নীচের দিকে ও ওপর, মাড়ি, জিভ এবং সাইনাসের ক্যান্সার এর অন্তর্গত। প্রাথমিক ধাপে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা না হলে ওরাল ক্যান্সার প্রাণঘাতীও হতে পারে। ওরাল ক্যান্সারে যেকেউ আক্রান্ত হতে পারে কিন্তু ৪০ বছরের বেশী বয়সের মানুষদের ঝুঁকি বেশী। তাছাড়াও, মহিলাদের থেকে পুরুষদের ঝুঁকি বেশী, বিশেষকরে তামাক, অত্যাধিক পরিমাণ অ্যালকোহল খান যারা কিংবা মাথা অথবা ঘাড়ের ক্যান্সারে আগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে।
লক্ষণ
প্রাথমিক ধাপে, মুখের ক্যান্সার সামান্য শারীরিক পরিবর্তন সহ নজরেই আসে না। লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে থাকতে পারেঃ
- মুখে লাল অথবা সাদা দাগ তৈরি হয়।
- মুখের মধ্যে আলসার হয় যার নিরাময় করা যায় না।
- গলায় কষ্ট এবং আওয়াজ ঘোড়ার মতন হয়।
- কোন কারণ ছাড়া মুখ থেকে রক্ত পড়া।
- আলগা দাঁত এবং খারাপ দাঁতের গঠন।
- মুখের ভেতর ফুলে যায় কিংবা লাম্প হয়।
- চিবাতে কিংবা গিলতে ব্যথা এবং কষ্ট।
- কানে ব্যথা যা কমে না।
জটিলতা
মুখের ক্যান্সার এবং তার চিকিৎসা থেকে বিভিন্ন জটিলতা হতে পারে যা হলঃ
ডিসফ্যাগিয়াঃ গিলতে কষ্ট হওয়া, যা থেকে ডিহাইড্রেশান ও পুষ্টির অভাব হয়।
ওরাল মিউকোসাইটিসঃ মুখের মিউকাস মেমব্রেনের জ্বালা-যন্ত্রণা এবং রেডিয়েশান ও কেমোথেরাপি করবার পরেও হতে পারে।
কথাঃ ক্যান্সারের চিকিৎসার ফলে রোগীর কথা বলার ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সংক্রমণঃ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকার জন্য কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশানের সময়ে ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়াল বা ফাঙ্গাল সংক্রমন হতে পারে।
রেডিয়েশান থেরাপি মুখের লালা তৈরি করা গ্রন্থির ক্ষতির পাশাপাশি এটা মুখকে শুষ্ক করে দেয় (স্কেরোস্টোমিয়া)। এটা চিবানোর জন্য ব্যবহৃত হওয়া পেশীরও ক্ষতি করে (ট্রিসমাস)।
ক্যান্সার ও তার চিকিৎসার সাথে জড়িত প্রচলিত সমস্যা হল অবসাদ বা ক্লান্তি।
বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তা।
কি কারণে হয়
ক্যান্সার ডিএনএ-র পরিবর্তনের ফোলে হয় যা থেকে কোষদের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয়। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মুখের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশী। বয়সকেও ঝুঁকির কারণ হিসেবে ধরা হয় কারণ এই ক্যান্সার ৪০ বছরের অধিক বয়সীদের হয়। মুখের ক্যান্সারের সঠিক কারণ জানা না গেলেও অনেক ধরনের ঝুঁকির কারণ আছে যা এই রোগ বাড়ার জন্য দায়ী, তা হলঃ
- প্রতিদিন তামাক সেবন, যথা সিগারেট, সিগার, পাইপ।
- প্রতিদিন তামাক, পানপাতা ও সুপারি চিবালেও ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- সুর্যের আলোয় অতিরিক্ত থাকলে ঠোঁটের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান।
- হিউমান প্যাপিলোমো ভাইরাসের (এইচপিভি) সংক্রমণ।
- দাঁতের অসমান তল কিংবা ভুল অথবা খারাপ ভাবে লাগানো ডেনটারের অস্বস্তি।
- মুখ বা মাথা বা ঘাড়ের ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস।
- রেডিয়েশানের সংস্পর্শ।
রোগ নির্ণয়
মুখের ক্যান্সার প্রথম ধাপে নজরে নাও পরতে পারে, কারণ এই ধাপে খুব সামান্য শারীরিক বদল হয়। কিন্তু ডাক্তার বা ডেন্টিস্টরা মুখের পরীক্ষা করার সময়ে এই চিহ্নগুলো বুঝতে পারবেন, যেহেতু তাদের অধিক জ্ঞান ও সচেতনতা থাকে। মুখের পরীক্ষার সময়ে ডাক্তার মুখ, মাথা ও ঘাড়ে লাম্প বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির চিহ্ন খোঁজে। ডাক্তার তাছাড়াও ক্ষত, লালচে বা সাদা দাগ হওয়া দেখার চেষ্টা করে, যা মুখের ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ। ডাক্তার সন্দেহজনক কিছু পেলে বায়োপসি করার সুপারিশ করে। মুখের ক্যান্সার যদি পরবর্তী ধাপে পৌঁছলে টেস্টের দ্বারা ক্যান্সারের ধাপ জানা হয় যার মধ্যে আছে এক্স-রে, সিটি বা এমআরআই এবং এন্ডোক্সোপি। গুরুতর কতটা তার ভিত্তিতে ক্যান্সার নীচের ধাপে ভাঙ্গা হয়ঃ
স্টেজ ১- এটা একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত টিউমারের ইঙ্গিত করে।
স্টেজ ২- টিউমারের মাপ যদি ১ থেকে ২ ইঞ্চি হয়।
স্টেজ ৩- টিউমার যদি আকারে বড় হয় কিন্তু এখনও ছড়ায় নি অথবা কাছের একটা লিম্প নোডে ছড়িয়েছে।
স্টেজ ৪- ক্যান্সার যখন কাছাকাছি ঘাড়ের বা শরীরের অন্যান্য অঙ্গের লিম্প নোডে ছড়িয়ে যায়।
প্রতিরোধ
জীবনযাত্রার কিছু রদবদল অভ্যাস করলে ওরাল বা মুখের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে, যা হলঃ
১. ধুমপান এবং যেকোন ধরনের তামাক সেবন বন্ধ করুন।
২. মাঝারি পরিমাণে অথবা অ্যালকোহল একেবারেই না পান করা।
৩. সূর্যের আলোয় অতিরিক্ত না থাকা এবং ত্বক ও ঠোঁটে সানস্ক্রিম ব্যবহার করা।
৪. নিজেই নিজেকে পরীক্ষা করা এবং নিয়মিত ডেন্টিস্টদের কাছে যাওয়া।
৫. এইচপিভি সংক্রমণ এড়ানো।
৬. স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া।
চিকিৎসা
মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা, ক্যান্সার কোথায় হয়েছে এবং কোন ধাপে আছে সেটার ওপর নির্ভরশিল। একজন রোগীর কোন একটা কিংবা চিকিৎসার সম্মিলিত প্রয়াস হতে পারে, যার অন্তর্গত হলঃ
সার্জারিঃ সার্জারির মধ্যে টিউমার ও তার আশেপাশের টিস্যু বাদ দেওয়া অন্তর্গত। টিউমার বড় হয়ে গেলে জিভ অথবা চোয়ালের হাড়ের একটা অংশ বাদ দেওয়া হয়। ক্যান্সার লিম্প নোড অবধি ছড়িয়ে গেলে সার্জারির দ্বারা এই লিম্প নোড ও পাশাপাশির ঘাড়ের টিস্যু বাদ দেওয়া হয়। ক্যান্সারকে সার্জারির মাধ্যমে বাদ দেওয়ার পরে খাওয়া ও কথা বলার ক্ষমতা পুনরায় অর্জন করবার জন্য রোগীদের রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির দরকার হতে পারে। ডেন্টাল ইমপ্লান্টেরও দরকার হতে পারে।
রেডিয়েশান থেরাপিঃ ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য এখানে অধিক ক্ষমতাশালী বিম যেমন এক্স-রে ও প্রোটোন ব্যবহার করা হয়। ক্যান্সারের প্রাথমিক ধাপে এটা হয়তবা একমাত্র চিকিৎসা কিন্তু অ্যাডভান্স ধাপে সার্জারি অথবা কেমোথেরাপির সাথে রেডিয়েশান থেরাপি দেওয়া হয়।
কেমোথেরাপিঃ ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য শক্তিশালী ওষুধের ব্যবহার এর অন্তর্গত। ক্যান্সারের অ্যাডভান্স ধাপে, বিশেষত আবার ক্যান্সার হবার সম্ভবনা থেকে গেলে রেডিয়েশান থেরাপির সাথে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়।
টারগেটেড ড্রুগ থেরাপিঃ এটা একধরনের কেমোথেরাপি কিন্তু কেমোথেরাপির স্টান্ডার্ড ওষুধের মতন কাজ করে না। কেমোথেরাপির স্টান্ডার্ড ওষুধ শরীরের দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ও বিভাজিত করার মতন সব কোষকে ধ্বংস করে, যেহেতু ক্যান্সার কোষ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও বিভাজিত হয়। অথচ টারগেটেড ড্রুগ থেরাপিতে, ওষুধ ক্যান্সার কোষদের নিশানা করে ও এইসব কোষদের বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে যে কোষ তার চেহারা বদলে দেয়। এইসব ওষুধ যথা সেটুক্সিমাব স্বাস্থ্যকর কোষে অবস্থিত একটা অংশের কাজ বন্ধ করে দিলেও ক্যান্সার কোষের ওপর এর প্রভাব আরও বেশী।
0 comments:
Post a Comment